মোশতাকের স্বল্পকালীন শাসনকাল বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় বয়ে আনে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া বাংলাদেশের সমস্ত অর্জন মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় এবং পাকিস্তানের ভাবধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করে পাঁচ দিনের মাথায় মোশতাক স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সামরিক আইন জারি করেন । ১৫ই আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি শুরু করলেন, 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' দিয়ে আর শেষ করলেন, ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলে । ভাষণে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে ঐতিহাসিক প্রয়োজন' আখ্যায়িত করে বলেন, ‘.... দেশের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন সকল মহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছেন । এটি ছিল মোশতাকের জাতিকে বিভ্রান্ত করার প্রথম প্রয়াস ।
সামরিক বাহিনীর কিছু অবসরপ্রাপ্ত ও বরখাস্তকৃত নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের অফিসারের প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রকে মোশতাক সমগ্র সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান হিসেবে বর্ণনার চেষ্টা করেন। আর এই নিষ্ঠুর বর্বর হত্যাকাণ্ডকে তিনি ‘সম্ভাবনার স্বর্ণদ্বার' বলে অভিহিত করেন । মোশতাক নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন । কেউ কেউ উৎসাহী ছিলেন না, এমন নয়। তবে, জীবনের ভয় দেখিয়েও মোশতাক জাতীয় চার নেতাসহ অনেককে বশীভূত করতে পারেননি। ১৭ই আগস্ট গ্রেফতার হন প্রধানমন্ত্রী এম. মনসুর আলী। ২২শে আগস্ট গ্রেফতার হন তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ।
কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, কোরবান আলীসহ প্রায় ২০ জন নেতাকে ২৩শে আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। আরও অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়, যারা মোশতাকের নেতৃত্ব মানতে রাজি হননি । মোশতাকের এ ঘৃণ্য ও অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে চরমমূল্য দিতে হয়েছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে ৩রা নভেম্বর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় । কারাগারের ভেতরে ঢুকে নির্মমভাবে জাতীয় চার নেতাকে যারা হত্যা করল, তাদের গ্রেফতার করা হলো না; কোনো বিচার হলো না । বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় যুক্ত হলো । মোশতাক এ সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী নানা প্রতিক্রিয়াশীল উদ্যোগ নেন । যেমন- মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা' বাতিল করে দেন। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ'-এর অনুকরণে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' স্লোগান চালু করেন । রেডিও পাকিস্তানের মতো করলেন ‘রেডিও বাংলাদেশ” ।
মোশতাকের সবচেয়ে নিন্দনীয় ও জঘন্য কাজ হলো ১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট একটি আদেশ জারি । এই আদেশ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না । কোনো সভ্য সমাজে এই ধরনের আইন হতে পারে না যে, হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না । মানবতাবিরোধী এই কালো আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫' নামে ১৯৭৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ গেজেট’- এ প্রকাশিত হয় । ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সরকার পরিবর্তনের জন্য যেসব পরিকল্পনা বা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে এবং যারা এর সাথে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি বিধানের জন্য কোনোরূপ আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে না। 'শুধু তাই নয়, খন্দকার মোশতাক ১৫ই আগস্টের খুনিচক্রকে দেশে-বিদেশে উচ্চপদ ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃতও করেন ।
১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ও তার সহযোগীরা ক্ষমতাকে স্থায়ী ও নিরাপদ করার জন্য সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এরই অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় । ২৫শে আগস্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন মোশতাক । ভারতে প্রশিক্ষণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় । মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথমরাষ্ট্র পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডে জুলফিকার আলী ভুট্টোর আনন্দের সীমা ছিল না । ভুট্টো খুনিচক্রকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, কারণ এটা ছিল তার কাছে পাকিস্তানের বিজয়, যা ১৯৭১ সালে হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার শামিল । চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যথাক্রমে ১৬ই ও ৩১শে আগস্ট, ১৯৭৫ । জনসমর্থনহীন মোশতাকের অবৈধ সামরিক সরকারের পতন হয় ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ।
Read more